সোমবার, জানুয়ারী ২০, ২০১৪

বদনাম নিয়েও কাজে ছুটেন মফস্বল সাংবাদিকরা

মাহাবুর আলম সোহাগ
ঢাকা: দেখতে দেখতে প্রায় এক যুগের কাছাকাছি পৌঁছেছে আমার সাংবাদিকতার বয়স। অথচ নিজের বয়স দুই যুগের একটু বেশি। বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই এ পেশার সঙ্গে জড়িত।

দীর্ঘদিন নিজ জেলায় সাংবাদিকতা করেছি, বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি ‘হাস্যকর’ কথাবার্তা আর ‘বদনাম’। অনেকে হেয় করে ‘সাংঘাতিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধুবও রয়েছেন, যারা প্রতিনিয়ত আমাকে ‘সাংঘাতিক’ বলে ডেকেছেন।

জানি না, এই বদনামটির পেছনের রহস্যটা কি? কেন সাংবাদিকদের দেখলে মানুষ এ কথাটি বলে থাকেন? কি মজা পান?
একজন প্রকৃত সাংবাদিকের ‘সাংঘাতিক’ কথাটি শুনতে নিশ্চয়ই অনেক অপমান বোধ হয়। শুনতে অনেক কষ্ট লাগে। আমি দেখেছি, কোনো সাংবাদিকই এ কথাটির জোরালো প্রতিবাদ করেন না। কারণ, তারা মনে করেন, এর প্রতিবাদ করলেই বড় কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই তারা হাসি মুখে কষ্ট করে হলেও কথাটি শুনে চুপ করে থাকেন।
এটি নিশ্চয়ই স্রেফ ভদ্রতা দেখানো ছাড়া অন্য কিছু নই। তাই বলবো, কারও পেশা নিয়ে বা কারও রুজি-রোজগার নিয়ে এমনটি বলা উচিত না। কারণ, প্রতিটি মানুষের কাছে তার পেশা অনেক ভালোবাসার। আমি তো মনে করি, এ পেশার মানুষগুলোকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করা উচিত। কারণ, প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে সাংবাদিকদের কাজের কারণে সুফল ভোগ করছেন। যা হয়তো তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারছেন না।

আমি দেখেছি, এ পেশার মানুষগুলোকে সহযোগিতা বা উৎসাহ দেওয়ার মতো মানুষের অভাব রয়েছে, কিন্তু পদে পদে অপমান আর নিরুৎসাহিত করার মানুষের অভাব নেই।
একদিকে মফস্বল সাংবাদিকদের যেমন মূল্যায়ন করেন না স্থানীয় মানুষগুলো, অন্যদিকে একই অবস্থা তাদের প্রধান কার্যালয়ের ক্ষেত্রেও। আমার ক্ষেত্রেও যা হয়েছে। দেখা গেছে, কোনো অনুষ্ঠান বা সভা-সেমিনারে গেলে সাংবাদিকদের সংবাদ পাঠানোর জন্য সামান্য অর্থের ব্যবস্থা করে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। যদিও এ ব্যবস্থাটি কিছু মানুষ বিরাট দুর্নীতি মনে করেন। আসলে সেটি ‘সন্মানী’ ছাড়া অন্য কিছু নই।

যারা এটিকে দুর্নীতি মনে করেন, আমি তাদের বলছি, বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া তাদের জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধিদের কিছুই দেন না। অফিস থেকে মাঝে মধ্যে ফোন করে যেটা দেন, সেটা হলো ঝাড়ি আর চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুমকি।
তবে মফস্বল সাংবাদিকদের দুর্নীতিবাজ মনে করার পেছনে কিছু কারণও রয়েছে। কিছু কিছু মানুষ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিছু হলুদ সাংবাদিক ও সাংবাদিক নামধারীদের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। তাদের সঙ্গে যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে থাকেন ওই অপ ও হলুদ সাংবাদিকরা।

পরবর্তীতে হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী ওই মানুষগুলোর সাংবাদিকের ওপর থেকেই আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। তাদের অনেকেও তখন সাংবাদিকমাত্রই সকলকে ‘সাংঘাতিক’ উপাধি দেন।
অন্যদিকে, বিভিন্ন ঘটনায় কোনো কোনো ভুক্তভোগী মানুষ কোনো সাংবাদিকের কাছে তার দুঃখ-কষ্টের কথা মিডিয়ায় তুলে ধরার আগে জানতে চান, কত টাকা দিতে হবে সংবাদ প্রকাশ-প্রচার করতে। অনেক ক্ষেত্রে এসব বদনামের জন্য আমারা নিজেরাই দায়ী। কারণ, ওই যে অপ ও হলুদ সাংবাদিক বা সাংবাদিক নামধারীরাও যে আমাদের কমিউনিটিরই অংশ।
যে কথা বলছিলাম, মফস্বল সাংবাদিকরা সংবাদ পাঠানোর জন্য যে প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য সন্মানী পেয়ে থাকেন, সেটাকে হালাল করার জন্য তড়িঘড়ি করে সংবাদ তৈরি করে অফিসে পাঠাতে হয়। যেহেতু তারা সামান্য সন্মানী পেয়ে থাকেন, সেহেতু চক্ষুলজ্জার তাগিদে সংবাদটা পাঠানোর পর অফিসে ফোন দিয়ে অনুরোধ করা হয়, সংবাদটি পরের দিনের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। অফিসে ফোন করার পর আরেক বিপদ। তারা বলেন, ‘‘কেন আপনি অনুরোধ করবেন? আপনি জানেন না, পত্রিকায় জায়গা কম? আপনি সংবাদ পাঠিয়েছেন, আপনার কাজ শেষ, সংবাদটা যাবে কি, যাবে না এটা আমাদের ব্যাপার।’’

এরপর আবার ওই প্রতিনিধিকে নিয়ে অফিসের লোকজনই শুরু করেন নানান কথা। তাদের ধারণা, মফস্বলের সাংবাদিকদের প্রচুর আয়। তারা যেখানেই যান, সেখানেই টাকা পান। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? তবে সন্মানী দেওয়া ওই প্রতিষ্ঠানের সংবাদটা যার পত্রিকায় আসে তিনি তো হাসি মুখে পত্রিকা নিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান বা লোকজনকে দিয়ে আসেন। কিন্তু যার পত্রিকায় সংবাদটা আসে না, তিনি পড়েন মহাবিপদে। কারণ, সংবাদ পাঠানোর টাকা পেয়েছি, অথচ সংবাদটা ছাপিয়ে দিতে পারলাম না এটা তখন অনেক লজ্জার বিষয় হয়ে দাড়ায়। ওই প্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর কোনো মুখ থাকে না। তখন চক্ষুলজ্জার খাতিরে অনেকটা পালিয়ে বেড়ানোর মতো অবস্থা হয়।

অন্যদিকে, ওই প্রতিষ্ঠান তো সংবাদটির জন্য অস্থির। তারাও বার বার ফোন করেন, কিন্তু পত্রিকায় তো সংবাদই নেই, ফোন ধরে বলবো কি? এসব কারণে ওই সাংবাদিকের প্রতি তাদের আস্থাও নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে আর দাওয়াত পাওয়া যায় না।

এভাবেই দরজা বন্ধ হয়ে যায় মফস্বল সাংবাদিকদের। অন্যদিকে বদনামের দরজাগুলো খুলে যায়। তারপরও শত বঞ্চনার মাঝেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য লেগে থাকেন তারা সাংবাদিকতায়। কারণ, পেশাটিতে একটি মোহ আছে, ভালোবাসা আছে। কোনোভাবেই ছেড়ে থাকা যায় না এ পেশাকে।



লেখক : মাহাবুর আলম সোহাগ, সহকারী বার্তা সম্পাদক, রাইজিংবিডি, ০১৯১১-৯৪৪৬৬৮
বদনাম নিয়েও কাজে ছুটেন মফস্বল সাংবাদিকরা
মাহাবুর আলম সোহাগ
ঢাকা: দেখতে দেখতে প্রায় এক যুগের কাছাকাছি পৌঁছেছে আমার সাংবাদিকতার বয়স। অথচ নিজের বয়স দুই যুগের একটু বেশি। বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই এ পেশার সঙ্গে জড়িত।
দীর্ঘদিন নিজ জেলায় সাংবাদিকতা করেছি, বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি ‘হাস্যকর’ কথাবার্তা আর ‘বদনাম’। অনেকে হেয় করে ‘সাংঘাতিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধুবও রয়েছেন, যারা প্রতিনিয়ত আমাকে ‘সাংঘাতিক’ বলে ডেকেছেন।
জানি না, এই বদনামটির পেছনের রহস্যটা কি? কেন সাংবাদিকদের দেখলে মানুষ এ কথাটি বলে থাকেন? কি মজা পান?
একজন প্রকৃত সাংবাদিকের ‘সাংঘাতিক’ কথাটি শুনতে নিশ্চয়ই অনেক অপমান বোধ হয়। শুনতে অনেক কষ্ট লাগে। আমি দেখেছি, কোনো সাংবাদিকই এ কথাটির জোরালো প্রতিবাদ করেন না। কারণ, তারা মনে করেন, এর প্রতিবাদ করলেই বড় কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই তারা হাসি মুখে কষ্ট করে হলেও কথাটি শুনে চুপ করে থাকেন।
এটি নিশ্চয়ই স্রেফ ভদ্রতা দেখানো ছাড়া অন্য কিছু নই। তাই বলবো, কারও পেশা নিয়ে বা কারও রুজি-রোজগার নিয়ে এমনটি বলা উচিত না। কারণ, প্রতিটি মানুষের কাছে তার পেশা অনেক ভালোবাসার। আমি তো মনে করি, এ পেশার মানুষগুলোকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করা উচিত। কারণ, প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে সাংবাদিকদের কাজের কারণে সুফল ভোগ করছেন। যা হয়তো তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারছেন না।
আমি দেখেছি, এ পেশার মানুষগুলোকে সহযোগিতা বা উৎসাহ দেওয়ার মতো মানুষের অভাব রয়েছে, কিন্তু পদে পদে অপমান আর নিরুৎসাহিত করার মানুষের অভাব নেই।
একদিকে মফস্বল সাংবাদিকদের যেমন মূল্যায়ন করেন না স্থানীয় মানুষগুলো, অন্যদিকে একই অবস্থা তাদের প্রধান কার্যালয়ের ক্ষেত্রেও। আমার ক্ষেত্রেও যা হয়েছে। দেখা গেছে, কোনো অনুষ্ঠান বা সভা-সেমিনারে গেলে সাংবাদিকদের সংবাদ পাঠানোর জন্য সামান্য অর্থের ব্যবস্থা করে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। যদিও এ ব্যবস্থাটি কিছু মানুষ বিরাট দুর্নীতি মনে করেন। আসলে সেটি ‘সন্মানী’ ছাড়া অন্য কিছু নই।
যারা এটিকে দুর্নীতি মনে করেন, আমি তাদের বলছি, বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া তাদের জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধিদের কিছুই দেন না। অফিস থেকে মাঝে মধ্যে ফোন করে যেটা দেন, সেটা হলো ঝাড়ি আর চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুমকি।
তবে মফস্বল সাংবাদিকদের দুর্নীতিবাজ মনে করার পেছনে কিছু কারণও রয়েছে। কিছু কিছু মানুষ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিছু হলুদ সাংবাদিক ও সাংবাদিক নামধারীদের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। তাদের সঙ্গে যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে থাকেন ওই অপ ও হলুদ সাংবাদিকরা।
পরবর্তীতে হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী ওই মানুষগুলোর সাংবাদিকের ওপর থেকেই আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। তাদের অনেকেও তখন সাংবাদিকমাত্রই সকলকে ‘সাংঘাতিক’ উপাধি দেন।
অন্যদিকে, বিভিন্ন ঘটনায় কোনো কোনো ভুক্তভোগী মানুষ কোনো সাংবাদিকের কাছে তার দুঃখ-কষ্টের কথা মিডিয়ায় তুলে ধরার আগে জানতে চান, কত টাকা দিতে হবে সংবাদ প্রকাশ-প্রচার করতে। অনেক ক্ষেত্রে এসব বদনামের জন্য আমারা নিজেরাই দায়ী। কারণ, ওই যে অপ ও হলুদ সাংবাদিক বা সাংবাদিক নামধারীরাও যে আমাদের কমিউনিটিরই অংশ।
যে কথা বলছিলাম, মফস্বল সাংবাদিকরা সংবাদ পাঠানোর জন্য যে প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য সন্মানী পেয়ে থাকেন, সেটাকে হালাল করার জন্য তড়িঘড়ি করে সংবাদ তৈরি করে অফিসে পাঠাতে হয়। যেহেতু তারা সামান্য সন্মানী পেয়ে থাকেন, সেহেতু চক্ষুলজ্জার তাগিদে সংবাদটা পাঠানোর পর অফিসে ফোন দিয়ে অনুরোধ করা হয়, সংবাদটি পরের দিনের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। অফিসে ফোন করার পর আরেক বিপদ। তারা বলেন, ‘‘কেন আপনি অনুরোধ করবেন? আপনি জানেন না, পত্রিকায় জায়গা কম? আপনি সংবাদ পাঠিয়েছেন, আপনার কাজ শেষ, সংবাদটা যাবে কি, যাবে না এটা আমাদের ব্যাপার।’’
এরপর আবার ওই প্রতিনিধিকে নিয়ে অফিসের লোকজনই শুরু করেন নানান কথা। তাদের ধারণা, মফস্বলের সাংবাদিকদের প্রচুর আয়। তারা যেখানেই যান, সেখানেই টাকা পান। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? তবে সন্মানী দেওয়া ওই প্রতিষ্ঠানের সংবাদটা যার পত্রিকায় আসে তিনি তো হাসি মুখে পত্রিকা নিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান বা লোকজনকে দিয়ে আসেন। কিন্তু যার পত্রিকায় সংবাদটা আসে না, তিনি পড়েন মহাবিপদে। কারণ, সংবাদ পাঠানোর টাকা পেয়েছি, অথচ সংবাদটা ছাপিয়ে দিতে পারলাম না এটা তখন অনেক লজ্জার বিষয় হয়ে দাড়ায়। ওই প্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর কোনো মুখ থাকে না। তখন চক্ষুলজ্জার খাতিরে অনেকটা পালিয়ে বেড়ানোর মতো অবস্থা হয়।
অন্যদিকে, ওই প্রতিষ্ঠান তো সংবাদটির জন্য অস্থির। তারাও বার বার ফোন করেন, কিন্তু পত্রিকায় তো সংবাদই নেই, ফোন ধরে বলবো কি? এসব কারণে ওই সাংবাদিকের প্রতি তাদের আস্থাও নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে আর দাওয়াত পাওয়া যায় না।
এভাবেই দরজা বন্ধ হয়ে যায় মফস্বল সাংবাদিকদের। অন্যদিকে বদনামের দরজাগুলো খুলে যায়। তারপরও শত বঞ্চনার মাঝেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য লেগে থাকেন তারা সাংবাদিকতায়। কারণ, পেশাটিতে একটি মোহ আছে, ভালোবাসা আছে। কোনোভাবেই ছেড়ে থাকা যায় না এ পেশাকে।

লেখক : মাহাবুর আলম সোহাগ, সহকারী বার্তা সম্পাদক, রাইজিংবিডি, ০১৯১১-৯৪৪৬৬৮
- See more at: http://barta9.com/2014/01/11/%e0%a6%ac%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%ae-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%87-%e0%a6%9b%e0%a7%81%e0%a6%9f%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%ae%e0%a6%ab/#sthash.qEtLT3yZ.dpufhttp://barta9.com/2014/01/11/%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%93-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%87-%E0%A6%9B%E0%A7%81%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AE%E0%A6%AB/
বদনাম নিয়েও কাজে ছুটেন মফস্বল সাংবাদিকরা
মাহাবুর আলম সোহাগ
ঢাকা: দেখতে দেখতে প্রায় এক যুগের কাছাকাছি পৌঁছেছে আমার সাংবাদিকতার বয়স। অথচ নিজের বয়স দুই যুগের একটু বেশি। বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই এ পেশার সঙ্গে জড়িত।
দীর্ঘদিন নিজ জেলায় সাংবাদিকতা করেছি, বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে পেয়েছি ‘হাস্যকর’ কথাবার্তা আর ‘বদনাম’। অনেকে হেয় করে ‘সাংঘাতিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধুবও রয়েছেন, যারা প্রতিনিয়ত আমাকে ‘সাংঘাতিক’ বলে ডেকেছেন।
জানি না, এই বদনামটির পেছনের রহস্যটা কি? কেন সাংবাদিকদের দেখলে মানুষ এ কথাটি বলে থাকেন? কি মজা পান?
একজন প্রকৃত সাংবাদিকের ‘সাংঘাতিক’ কথাটি শুনতে নিশ্চয়ই অনেক অপমান বোধ হয়। শুনতে অনেক কষ্ট লাগে। আমি দেখেছি, কোনো সাংবাদিকই এ কথাটির জোরালো প্রতিবাদ করেন না। কারণ, তারা মনে করেন, এর প্রতিবাদ করলেই বড় কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই তারা হাসি মুখে কষ্ট করে হলেও কথাটি শুনে চুপ করে থাকেন।
এটি নিশ্চয়ই স্রেফ ভদ্রতা দেখানো ছাড়া অন্য কিছু নই। তাই বলবো, কারও পেশা নিয়ে বা কারও রুজি-রোজগার নিয়ে এমনটি বলা উচিত না। কারণ, প্রতিটি মানুষের কাছে তার পেশা অনেক ভালোবাসার। আমি তো মনে করি, এ পেশার মানুষগুলোকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করা উচিত। কারণ, প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে সাংবাদিকদের কাজের কারণে সুফল ভোগ করছেন। যা হয়তো তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারছেন না।
আমি দেখেছি, এ পেশার মানুষগুলোকে সহযোগিতা বা উৎসাহ দেওয়ার মতো মানুষের অভাব রয়েছে, কিন্তু পদে পদে অপমান আর নিরুৎসাহিত করার মানুষের অভাব নেই।
একদিকে মফস্বল সাংবাদিকদের যেমন মূল্যায়ন করেন না স্থানীয় মানুষগুলো, অন্যদিকে একই অবস্থা তাদের প্রধান কার্যালয়ের ক্ষেত্রেও। আমার ক্ষেত্রেও যা হয়েছে। দেখা গেছে, কোনো অনুষ্ঠান বা সভা-সেমিনারে গেলে সাংবাদিকদের সংবাদ পাঠানোর জন্য সামান্য অর্থের ব্যবস্থা করে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। যদিও এ ব্যবস্থাটি কিছু মানুষ বিরাট দুর্নীতি মনে করেন। আসলে সেটি ‘সন্মানী’ ছাড়া অন্য কিছু নই।
যারা এটিকে দুর্নীতি মনে করেন, আমি তাদের বলছি, বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া তাদের জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধিদের কিছুই দেন না। অফিস থেকে মাঝে মধ্যে ফোন করে যেটা দেন, সেটা হলো ঝাড়ি আর চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুমকি।
তবে মফস্বল সাংবাদিকদের দুর্নীতিবাজ মনে করার পেছনে কিছু কারণও রয়েছে। কিছু কিছু মানুষ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিছু হলুদ সাংবাদিক ও সাংবাদিক নামধারীদের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। তাদের সঙ্গে যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে থাকেন ওই অপ ও হলুদ সাংবাদিকরা।
পরবর্তীতে হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী ওই মানুষগুলোর সাংবাদিকের ওপর থেকেই আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। তাদের অনেকেও তখন সাংবাদিকমাত্রই সকলকে ‘সাংঘাতিক’ উপাধি দেন।
অন্যদিকে, বিভিন্ন ঘটনায় কোনো কোনো ভুক্তভোগী মানুষ কোনো সাংবাদিকের কাছে তার দুঃখ-কষ্টের কথা মিডিয়ায় তুলে ধরার আগে জানতে চান, কত টাকা দিতে হবে সংবাদ প্রকাশ-প্রচার করতে। অনেক ক্ষেত্রে এসব বদনামের জন্য আমারা নিজেরাই দায়ী। কারণ, ওই যে অপ ও হলুদ সাংবাদিক বা সাংবাদিক নামধারীরাও যে আমাদের কমিউনিটিরই অংশ।
যে কথা বলছিলাম, মফস্বল সাংবাদিকরা সংবাদ পাঠানোর জন্য যে প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য সন্মানী পেয়ে থাকেন, সেটাকে হালাল করার জন্য তড়িঘড়ি করে সংবাদ তৈরি করে অফিসে পাঠাতে হয়। যেহেতু তারা সামান্য সন্মানী পেয়ে থাকেন, সেহেতু চক্ষুলজ্জার তাগিদে সংবাদটা পাঠানোর পর অফিসে ফোন দিয়ে অনুরোধ করা হয়, সংবাদটি পরের দিনের পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। অফিসে ফোন করার পর আরেক বিপদ। তারা বলেন, ‘‘কেন আপনি অনুরোধ করবেন? আপনি জানেন না, পত্রিকায় জায়গা কম? আপনি সংবাদ পাঠিয়েছেন, আপনার কাজ শেষ, সংবাদটা যাবে কি, যাবে না এটা আমাদের ব্যাপার।’’
এরপর আবার ওই প্রতিনিধিকে নিয়ে অফিসের লোকজনই শুরু করেন নানান কথা। তাদের ধারণা, মফস্বলের সাংবাদিকদের প্রচুর আয়। তারা যেখানেই যান, সেখানেই টাকা পান। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? তবে সন্মানী দেওয়া ওই প্রতিষ্ঠানের সংবাদটা যার পত্রিকায় আসে তিনি তো হাসি মুখে পত্রিকা নিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান বা লোকজনকে দিয়ে আসেন। কিন্তু যার পত্রিকায় সংবাদটা আসে না, তিনি পড়েন মহাবিপদে। কারণ, সংবাদ পাঠানোর টাকা পেয়েছি, অথচ সংবাদটা ছাপিয়ে দিতে পারলাম না এটা তখন অনেক লজ্জার বিষয় হয়ে দাড়ায়। ওই প্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর কোনো মুখ থাকে না। তখন চক্ষুলজ্জার খাতিরে অনেকটা পালিয়ে বেড়ানোর মতো অবস্থা হয়।
অন্যদিকে, ওই প্রতিষ্ঠান তো সংবাদটির জন্য অস্থির। তারাও বার বার ফোন করেন, কিন্তু পত্রিকায় তো সংবাদই নেই, ফোন ধরে বলবো কি? এসব কারণে ওই সাংবাদিকের প্রতি তাদের আস্থাও নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে আর দাওয়াত পাওয়া যায় না।
এভাবেই দরজা বন্ধ হয়ে যায় মফস্বল সাংবাদিকদের। অন্যদিকে বদনামের দরজাগুলো খুলে যায়। তারপরও শত বঞ্চনার মাঝেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য লেগে থাকেন তারা সাংবাদিকতায়। কারণ, পেশাটিতে একটি মোহ আছে, ভালোবাসা আছে। কোনোভাবেই ছেড়ে থাকা যায় না এ পেশাকে।

লেখক : মাহাবুর আলম সোহাগ, সহকারী বার্তা সম্পাদক, রাইজিংবিডি, ০১৯১১-৯৪৪৬৬৮
- See more at: http://barta9.com/2014/01/11/%e0%a6%ac%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%ae-%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a7%87%e0%a6%93-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%87-%e0%a6%9b%e0%a7%81%e0%a6%9f%e0%a7%87%e0%a6%a8-%e0%a6%ae%e0%a6%ab/#sthash.qEtLT3yZ.dpuf